লেখকঃ ঈশানী রায়চৌধুরী প্রকাশিতঃডিসেম্বর ০৪, ২০১৯ কোলকাতা থেকে।
আমরা হিন্দু| বাড়িতে ঠাকুরদেবতাকে ফুল জল বাতাসা দেওয়া হয়, দুর্গাপুজোয় অঞ্জলিও| ঠাকুমা তো ষষ্ঠী, ইতু, জয় মঙ্গলবার কোনও কিছুই বাদ দিতেন না| তবে কোনও কিছু নিয়েই আতিশয্য আগেও দেখিনি, এখনও নেই| আমার বাবার এক প্রিয় ছাত্র ছিল| আমাদের চেয়ে সামান্য সিনিয়র| পড়ত প্রেসিডেন্সিতে| তীক্ষ্ণ মেধা, শীলিত আচরণ, মার্জিত রুচি| ধর্মে মুসলমান| আমার সঙ্গে তার দু-চারটে কথা হত বটে, কিন্তু কোনও প্রেম ট্রেম ছিল না| তার মেধার কারণে হয়ত খানিক ঈর্ষাই করতাম| একবার বাবাকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমরা তো হিন্দু, ধরো যদি আমি ওকে বিয়ে করতে চাইতাম, তুমি কী করতে?’
খুব অবাক গলায় বাবা বলেছিলেন, ‘কী আবার করতাম! প্রথমে একটা ঝটকা লাগত, কিন্তু সেটা ধর্মের কারণে নয়… তুমি প্রেম করছ, আচমকা সে কথা জানতে পেরে| তারপর সেটা ছাপিয়ে মনে জায়গা করে নিত যে তুমি আমার সন্তান, আর ও আমার ছাত্র যখন, সন্তানতুল্য| কাজেই স্নেহ, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব… এগুলো কি ধর্মের চেয়েও দামি বা জরুরি নয়?’
অনেক বছর কেটে গেছে| এখন ভাবি, বাবা সাড়ে তিন দশক আগে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ হিসেবে সময়ের থেকেএগিয়ে ছিলেন| খুব গর্ব হয়| খুব|
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এই সব ধর্ম-অধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনি কখনও। পড়েছি মিশনারি স্কুল-কলেজে| সেখানে চ্যাপেলে মেরি বা যিশুর কথা হত বটে, কিন্তু তাতে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া ছিল না| চ্যাপেল ছিল, আমরা মাঝেমধ্যে ইচ্ছেসুখে সেখানে গিয়ে বাইরে রাখা মন্ত্রপূত জর্ডন নদীর জল মাথায় ছিটিয়ে ভেতরে হাঁটু গেড়ে বসে বিড়বিড় করে প্রার্থনাও করতাম| সাধারণ রোজের প্রার্থনা তো উঠোনেই হত| ক্লাস নাইনে উঠলাম যখন, একটা নতুন ঘর হল আমাদের| প্রেয়ার রুম| কিন্তু প্রেয়ার রুমের ভাবনাটা আলাদা| ঘরটি আধো-অন্ধকার, মেঝেতে জাজিম, মোমদানিতে মোমবাতি, কিছু ফুল সাজানো ফুলদানিতে, আর আবছা ধূপের গন্ধ| টাটকা ফুল আর নতুন মোম রোজ| ধূপও জ্বালানো হত নিয়ম করে| কোনও দেবতা, ধর্মগুরুর ছবি বা মূর্তির বালাই নেই| শুধু চোখ বুজে প্রার্থনা করা আছে| এক অদ্ভুত ঈশ্বর-নিরীশ্বরবাদের ধারণা| জুলুম নেই, বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই, ধরাবাঁধা সময় নেই| প্রার্থনার কি আর নির্দিষ্ট সময় বলে কিছু থাকে? ওই প্রেয়ার রুম আমাদের নিজেদের চিনতে শেখার প্রথম ধাপটি তৈরী করে দিয়েছিল|
ক্লাস টেনে আমাদের ধর্মশিক্ষার ক্লাস নিতে এসেছিলেন ফাদার ফালোঁ| একজন লম্বা রোগাসোগা পাদ্রী, সাহেবি চেহারা, হালকা দাড়ি| বাইসাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে মানিকতলার বাজার পেরিয়ে বিডন স্ট্রিট ধরে আসতেন আমাদের স্কুলের দিকে| পথে এটা ওটা কিনছেন| দুটো আপেল, চারটে কলা, এক থাবা আঙুর, এক মুঠো খেজুর, এমনকি চাট্টি আলু-পেঁয়াজও| প্রত্যেক ফেরিওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে কথাও বলছেন বাংলায়| কিন্তু কেনার পর সওদা যে কোথায় রাখছেন, দেখা যাচ্ছে না| পরে বুঝেছিলাম, সাদা আলখাল্লার পকেটে| আমার বিশ্বাস, আলখাল্লার এধার ওধার জুড়ে চারদিকেই ঘুরিয়ে পকেটের মতো ব্যবস্থা| সারা মহল্লার বাজার ঢুকে যায় রোজ| পকেট নির্ঘাত কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত| সব সময়েই মুখে দেবশিশুর মতো হাসি|
আমাদের স্কুলে ফাদার যেতেন আমাদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতে| আমাদের তখন ক্লাস টেন| ফাদার মানেই ‘ধম্ম আলোচনা’| ওঁর বিদেশি ধাঁচের বাংলা উচ্চারণে ‘ধর্ম’ যদিও ‘ধম্মে’ পর্যবসিত হত, তাতে ধর্মচর্চার আর দর্শনচর্চার গুরুত্ব কিছুমাত্র কমত না| উশখুশ করতাম সাইকোলজি রুমে বসে| দু’সেকশনের কম্বাইনড ক্লাস, হরি ঘোষের গোয়াল| তবে বেশিটাই মিটমিটে দুষ্টুমি| মিশনারি স্কুলে অনুশাসনের প্রাবল্য খুব বেশি| কী যে বড় বড় তত্ত্বকথা! ভালো লাগত না, ঘুম পেয়ে যেত| তার ওপর ফাদার মাঝেমাঝেই ধর্ম, দর্শন… এই সবের ওপরে রচনা লেখার হোমওয়ার্ক দিতেন| ছাইপাঁশ যা মনে আসে, লিখতাম। এদিক সেদিক থেকে উদ্ধৃতি তুলে অল্পবিদ্যা জাহির করতাম| ভাবতাম, কী হয় ধর্ম আর নীতিশিক্ষার ক্লাস করে?
তখন বুঝিনি| এখন কিছুটা বুঝি| এই মানুষটি কোনো দিন বাইবেল চর্চা করেননি ক্লাসে, ধর্মালোচনা যা করতেন, পুরোটাই দর্শনভিত্তিক এবং তা সর্বধর্মসমন্বয়ের দর্শন| তাতে ঝড়ের মতো আসত গীতা-বাইবেল-কোরান-উপনিষদ সব| বলতেন… ধর্ম-কর্ম কর| কর্মের মধ্যে দিয়ে ধর্মপালন, মনুষ্যত্বের ধর্মপালন| বিবেকানন্দর কথা উঠে আসত| আসত হরিজনদের কথা| সকলের জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের প্রয়োজনের কথা| ‘ধর্ম’-কে মনের ‘চক্ষু’ দিয়ে ‘দর্শন’ করতে শেখার কথা| এখন বুঝি, অমন চক্ষুষ্মান-চক্ষুষ্মতী হয়ে ওঠাটা এখনকার পৃথিবীতে সকলের বেঁচে থাকার জন্য কতটা জরুরী!
দিল্লিতে প্রবাস-জীবনে বুঝিনি, ব্যাঙ্গালোরে এসে দেখি দক্ষিণীরা আদতে বেজায় গোঁড়া| ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে বিস্তর গোলমেলে ব্যাপার তো আছেই, এমনকি তামিলদের মধ্যে তা এতটাই প্রকট যে আয়ার-আয়েঙ্গারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও নাকি হয় না| কারণ এক গোষ্ঠী বৈষ্ণব, অন্যটি শৈব| এখন যদিও অতটা আর নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেখি না, তবু দু’যুগ আগে কিন্তু এই বৈষম্য উড়িয়ে দেওয়া যেত না|
ঠিক এমন সময়ে আমার প্রতিবেশী একদিন এলেন আমার দরজায়| হাতে রুপোর রেকাবিতে একরাশ মিষ্টি| পালঘাটের তামিল ব্রাহ্মণ, যাঁদের গোঁড়ামির অহঙ্কার খুব| এ বাড়ির মেয়েটি বিদেশে পড়তে গেছে| দেশে থাকতেই তার প্রেম ছিল একটি ছেলের সঙ্গে, সেও বিদেশে| ছেলেটি মুম্বইয়ের একটি মসজিদের ইমামের ছেলে| দু’জন বিয়ে করেছে| রেজিস্ট্রি বিয়ে| কোনও পুরোহিত, কোনও মৌলবী ছিল না| মেয়েটির মা আমাকে মিষ্টি দিয়ে বললেন, ‘ওরা বিয়ে করেছে| আমি জানি, এ বিল্ডিংয়ের কেউ মিষ্টি খেতে রাজি হবে না হয়ত, তুমি খেও| প্রার্থনা কোরো, যেন ওরা সুখি হয়|’ ওদের দু’টি ফুটফুটে সন্তান হল| নাম রেখেছে অয়ন আর সায়নী| নামে কোনও ধর্মের ছায়া পড়েনি, স্কুলের ফর্মেও রিলিজিয়নের ব্লকটাতে লেখাআছে ‘হিউম্যানিটি’|
আমার বাড়িতে একটা ঠাকুরঘর আছে| তাতে অবশ্য ঠাকুরদেবতাদের সঙ্গে অনেক কিছুই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকে | কুমোরটুলি থেকে একটি কালী প্রতিমা বানিয়ে এনেছিলাম| কাঠের বাক্স করে নিয়ে তো এলাম, তারপর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল| খুঁজে খুঁজে কোথাও মাপসই কাচের বাক্স মেলে না| শেষে উদ্ধার করল আনোয়ার| তার ছিল রঙিন মাছের কারবার| অবসর সময়ে খুটখাট হাতের কাজ করত| বলল, ‘আমি বানিয়ে দিলে তোমার আপত্তি আছে?’
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে বললাম, ‘আপত্তি কীসের?’
ও বলল, ‘মানে ঠাকুরদেবতার ব্যাপার তো! আমি তো হিন্দু নই!’
বললাম, ‘আনোয়ার, তুমি যদি এই ছুতোয় বাক্স বানিয়ে না দাও, আমার ঠাকুর কিন্তু খুব রাগ করবে তোমার ওপর|’
আনোয়ার এক গাল হেসে নিখুঁত মাপে বাক্স বানিয়ে দিয়েছিল| সেই কাচের ঘরেই প্রতিমার অবস্থান|
এগুলো সবই খুব তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনা| তবে শেষ কথা একটাই| প্রিচিংয়ের থেকে প্র্যাকটিস বেশি জরুরি আর তা শুরু করা দরকার নিজেদের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেই|
প্রথমে ঘরের ভেতরটুকু পরিচ্ছন্ন করি, তারপর চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোন, আর সবশেষে দিগন্তের বিস্তার রইলই!
➡বিঃদ্রঃ-আরো মজার ও রহস্যময় কিছু জানতে হলে এখানে ক্লিক করুন⏯
Leave a Reply