?নারীর চেহারা ঢেকে রাখা ফরয-চার মাযহাবের সম্মিলিত অবস্থান?
।।দিঘলিয়া ওয়েব ব্লগঃঃঅনুসন্ধান টিম।।
?লিখেছেনঃমুফতী দেলোয়ার বিন গাজী?
একজন গবেষকের জন্য আবশ্যক হলো দলীল ও মূলনীতির আলোকে মাসআলা স্টাডির পাশাপাশি যুগেরও স্টাডি করা এবং মাকাছীদুশ শরীআহ সামনে রাখা। এক হাজার বছর পূর্বে যা নারীদের জন্য সাধারণ আমল ছিল আজ তা ঈমান-আকীদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বোরকা-পর্দাকে অনেক মুসলিমও আজ নারীর জন্য জুলুম, অবরোধ ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে বিশ্বাস করছে, এমনকি পর্দা করার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান শাস্তিও দিচ্ছে! এই যুগের ব্যাপারে সতর্ক করেই রাসূল সা. বলেছেন: يصبح الرجل فيها مؤمنا ويمسى كافرا ‘সে যুগে কারো সকালটা থাকবে মুমিন অবস্থায়, অথচ বিকেলে দেখা যাবে সে কাফের।’
আজ বিশ্বের তাগুতি শক্তিও মুসলিম পুরুষের মুখের দাড়ি আর মুসলিম মহিলার মুখের নেকাবকে কঠিন শত্রু মনে করে। কারণ এদুটো জিনিস নারী-পুরুষের চরিত্রের রক্ষা-কবজ এবং ইসলামের সৌন্দর্যের সাইনবোর্ড।
আমরা জানি ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে বোরকা পরার বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে। গত ১১ এপ্রিল২০১৯ থেকে ফ্রান্সে এ আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী বোরকা পরা কোনো মহিলা যদি তার মুখমন্ডল দেখাতে না চান, তবে পুলিশ তাকে সর্বোচ্চ ১৫০ ইউরো বা ২১৬ ডলার জরিমানা করবে এবং তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে-যদি তিনি রাস্তা, পার্ক বা শপিংমলের মতো প্রকাশ্যস্থানে বোরকা পরে বের হন।
একজন গবেষকের সামনে এ বিষয়টিও থাকবে যে, যে যুগে নেকাব পরা নারীও ফেতনায় পতিত হচ্ছে সে যুগে নারীকে নেকাবহীন রাখা যুক্তিযুক্ত কী না!
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের সালাত শেষ করতেন তখন মহিলাগণ চাঁদরে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করে ঘরে ফিরতেন। অন্ধকারের কারনে তখন তাঁদেরকে চেনা যেতো না।
(বুখারী-হা:৮২৫; সহীহ মুসলিম-হা:১৩৩২, ১৩৩৪; আবু দাউদ-হা:৪২৩; তিরমিজী-হা:১৫৩; ইবনে মাজাহ-হা:৬৬৯; সূনানে নাসাঈ-হা৫৪৬) এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেলো, সে যুগের মহিলারা আপাদমস্তক ঢেকে পর্দাসহ সালাত আদায় করতেন।
অন্য হাদীসঃ
আমরা বিনতে আব্দুর রহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি আয়িশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, রাসূল স. যদি এ যুগের নারীদের আচরণের অবস্থা দেখতেন, তবে তাদেরকে বনী ইসরাঈলী নারীদের ন্যায় মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করতেন।
(সহীহ বুখারী-হা/৮২৭; মুসলিম-হা/৮৮৩; আবু দাউদ-হা/৫৬৯; আহমাদ-হা/২৪৬৪৬)
রাসূল স. এর যুগের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে মহিলাদের মসজিদে গমন যেখানে নিষিদ্ধের পর্যায়ে পৌছেঁছে বলে মনে করেছিলেন, সেখানে চৌদ্দশত বছর পরে শত ফেতনার মাঝে নারীদের অবস্থা এখন কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা অবশ্যই গবেষকদের ভাববার বিষয়!
চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে জমহূরে উলামা ও চার মাযহাবের বর্তমান সম্মিলিত অবস্থান:
ইমাম আবু হানিফা ও হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে অনেককে বলতে শুনা যায় যে, নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয় বরং খোলা রাখা বৈধ, এটাতো হানাফী মাযহাবেরই ফতোয়া!
আমি বলবো এভাবে বলাটা ইমাম আবু হানিফা, হানাফী মাযহাবসহ অপরাপর মাযহাব ও উক্ত মাসআলার ব্যাপারে অজ্ঞতা ও উদাসীনতার পরিচায়ক।
*ফেতনার আশঙ্কা না থাকার শর্তে কিছু দলীলের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানিফা রহ. সেই সোলানী যুগে চেহারা খোলা রাখার রুখসাত বা বৈধতার মতামত দিয়েছিলেন বটে কিন্তু পরবর্তী যুগে যখন চূড়ান্ত ফেতনা নিশ্চিত হয়ে শর্ত বিলীন হয়ে যায়, তখন ইমাম আবু হানিফার মূলনীতির আলোকেই তা অবৈধ হয়ে যায়। ফলে হানাফী মাযহাবের উলামায়ে কেরাম মূলনীতি ও দলীলের ভিত্তিতেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তা পর পুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়। এমতাবস্থায় হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে রুখসাতের পক্ষে বলা সুস্পষ্ট অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মালেকী মাযহাবের ক্ষেত্রেও একই কথা
অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের মতো মালেকী মাযহাবেও শর্তসাপেক্ষে রুখসাত ছিল, কিন্তু একই কারণে তাদেরও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নারীর চেহারা খোলা রাখা জায়েয নেই।
উল্লখ্য যে, শুরু থেকেই হানফী ও মালেকী মাযহাবের অনেক উলামায়ে কেরামক কোন শর্ত ছাড়াই চেহারা খোলা রাখাকে নাজায়েয বলে এসেছেন।
অপরপক্ষ দলীলের ভিত্তিতেই ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এবং শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের উলামায়ে কেরাম চেহারাকে ফরয পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং খোলা রাখাকে সর্বাবস্থায় নাজায়েয বলেছেন, ফেতনার আশঙ্কা থাকুক চাই না থাকুক।
চার মাযহাবের বাইরে আহলে হাদীস, সালাফীসহ অপরাপর বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামও নারীর চেহারা খোলা রাখাকে নাজায়েয বলেছেন। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম।
ফলাফলঃ
চার মাযহাব এবং জমহূরে উলামার বর্তমান সম্মিলিত অবস্থান হলো নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তা পর পুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়। বর্তমান ফেতনার যুগে এর বাইরে বলার সুযোগও নেই।
نستطيع أن نخلص مما تقدم بأن علماء المذاهب الأربعة يكادون يتفقون على تغطية المرأة جميع بدنها عن الأجانب، سواء منهم من يرى أن الوجه والكفين عورة، ومن يرى أنهما غير عورة لكنه يوجب تغطيتهما فى هذا الزمان لفساد أكثر الناس. أدلة الحجاب: ٤٧٤
সূত্র: মিশর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট লাইব্রেরি দারু ইবনিল যাওজী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, আদিল্লাতুল হিযাব )أدلة الحجاب পৃষ্ঠা:৪৭৪, প্রথম সংস্করণ, ২০০৫ ইং ফতহুল বারী: ৯/৩৩৭, নাইলুল আওতার: ৬/১১০ রওযাতুত তালেবীন:৫/৩৩৬
হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. বলেন: চার মাযহাবের সকল ইমামের ঐকমত্যে মহিলাদের জন্য পর্দার কাপড়, বোরকা, বড় চাদর ইত্যাদি দ্বারা সমস্ত দেহ ও মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখা অপরিহার্য। (মা‘আরিফুল কুরআন, ৭/ ২২০)
এখানে চার মাযহাবের কিছু বিখ্যাত গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি, যেগুলোতে চেহারা আবৃত রাখার বিধান পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে।
হানাফী মাযহাবঃ
আহকামুল কুরআন, আলজাসসাস ৩/৩৭১-৩৭২; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৪০৭; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারের সাথে), ৬/৩৭০; রদ্দুল মুহতার (ফতওয়া শামী) ১/৪০৬; আলবাহরুর রাইক ২/২৭০
মালেকী মাযহাব :
আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ৩/১৫৭৯; আলজামি লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবী ১২/১১৫; আকরাবুল মাসালিক, আহমদ দরদীর ১/২৮৯; আরিজাতুল আহওয়াযী, ইবনুল আরাবী ৪/৫৬; মাওয়াহিবুল জলীল, হাত্তাব ২/১৮১; হাশিয়াতুদ দুসূকী, মুহাম্মাদ আদ দুসূকী ১/২১৪
শাফেয়ী মাযহাবঃ
নেহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ: ৬/১৮৭; রওযাতুত তালেবীন ৭/২১; হাওয়াশিশ শিরওয়ানী ২/৩৩৩
হাম্বলী মাযহাব :
আল আদাবুশ শরইয়্যা, ইবনু মুফলিহ ১/২৯৭; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ২/৩২৮; আলইনসাফ, মারদাভী ১/৪৫২
চেহারা আবৃত করা ফরয বিষয়ে কুরআনের দলীল
সূরা আহযাব এর আয়াত
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিন স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাব নিজেদের মাথার উপর থেকে টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
(সূরা আহযাবঃ আয়াত- ৫৯)
আল্লামা কুরতুবী রহঃ উল্লেখ করেছেন পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতের হুকুম অনুযায়ী জিলবাব দ্বারা জামাকাপড় ও ওড়না সহ সমস্ত শরীর ও চেহারা ঢাকতে হবে। (আল-জামি’ লি-আহকামিল কুরআন, কুরতুবী-১৪/২৪৩)
ইমাম সূয়ূতী রহঃ এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এটি সকল নারীর জন্য পর্দার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত । এতে তাদের মাথা ও চেহারা ঢাকা ফরজ করা হয়েছে।
(আওনুল মা’বুদ-১১/১৫৮ পৃ.)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন,
أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن فى حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب، ويبدين عينا واحدة.
“আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে বিশেষ চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (ফাতহুল বারী,শরহুল বুখারী: ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪, তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী: ২০/৩২৪)
তাবেয়ী আবীদাহ সালমানী রহ. এর বক্তব্য
عن ابن سيرين قال: سألت عبيدة سلمانى عن قوله- يدنين عليهن من جلابيبهن- فقال بثوبه فغطى رأسه ووجهه وأبرز ثوبه عن إحدى عينيه
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযতর ইবনে সীরিন রহঃ বলেন, আমি (ইবনে মাসউদ রা. এর শাগরিদ, বিখ্যাত তাবেয়ী)আবিদাহ সালমানী রহঃ কে উক্ত আায়াতের ব্যাখা সম্পর্কে জিঙ্গাসা করলে তিনি তার “বড় চাদর দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করলেন এবং এক চোখ খোলা রাখলেন”। অর্থাৎ জিলবাব দ্বারা চেহারা আবৃত করার বাস্তব ব্যাখ্যা দেখালেন। (তাফসীরে তাবারী: ২০/৩২৪, তাফসীরে ইবনে কাছীর- ৩/৮২৫)
সূরা নূর এর আয়াত
قُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ.
হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তবে যা এমনিতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে তা ব্যতিক্রম। এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। (সূরা আন-নূর: আয়াত- ৩১)
এই আয়াতে নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর চেহারাই হলো নারীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যতা। وجه المرأة هو مجمع المحاسن، ومعيار الجمال، ومصباح البدن- أدلة الحجاب: ٤٧٤
এই আয়াত প্রসঙ্গে সহী বুখারীতে বর্ণিত হাদীস-
আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, عن عائشة أنها قالت: يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها. আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন।যখন আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত,
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ‘‘তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন ওড়না দ্বারা আবৃত করে’’
নাযিল করলেন, তখন তারা নিজ চাদর ছিঁড়ে ওড়না হিসাবে ব্যবহার করল। (সহীহ বুখারী: হাদীস-৪৩৯৮)
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, ‘ফাখতামারনা’ أى غطين وجوههن অর্থ তারা (চাদর ছিড়ে তা দ্বারা) মুখমন্ডল আবৃত করেছেন। (ফাতহুল বারী-৮/৩৪৭ পৃ.)
আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, ‘ফাখতামারনা বিহা’ অর্থাৎ যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী-১৯/৯২ পৃ.)
আল্লামা শানকীতী রাহ. বলেন, এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, উপরোক্ত মহিলা সাহাবীগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুখমন্ডল আবৃত করারও আদেশ করেছেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনার্থে নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।
(আল বায়ান-৩৪২ পৃষ্ঠা)
চেহারা আবৃত করা ফরয বিষয়ে হাদীসের দলীল
রাসূল স. ইরশাদ করেন: المرأة عورة، فإذا خرجت استشرفها الشيطان- ترمذى: ١١٧٣ “নারী হলো গোপনীয় বস্তু, যখন সে প্রকাশ্যে বের হয়, শয়তান তার দিকে উকি দিতে থাকে।” তিরমিযী: হাদীস-১১৭৩ এই হাদীসে নারীর আপাদমস্তক পুরো দেহকেই আওরাত বলা হয়েছে।
মুস্তাদরাকে হাকিম এর সহী হাদীস
ﻋَﻦْ ﺃَﺳْﻤَﺎﺀَ ﺑِﻨْﺖِ ﺃَﺑِﻲْ ﺑَﻜْﺮٍ ﺍﻟﺼِّﺪِّﻳْﻖِ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻛُﻨَّﺎ ﻧُﻐَﻄِّﻲْ ﻭُﺟُﻮْﻫَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ، ﻭَﻛُﻨَّﺎ ﻧَﻤْﺘَﺸِﻂُ ﻗَﺒْﻞَ ﺫَﻟِﻚَ ﻓِﻲ ﺍﻻِﺣْﺮَﺍﻡِ-
আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) বলেন, আমরা পুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম এবং ইহরামের পূর্বে চিরুনী করতাম। (মুস্তাদরাকে হাকিম:১/৪৫৪, হাদীস নং-১৬৬৮, ইরওয়া হা/১০২৩; ছহীহ ইবনু খুযাইমা-হা/২৬৯০)
হাদিসটিতে,, “আমরা” বলা হয়েছে। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেলো যে, মহিলা সাহাবীয়য়াগন পরপুরুষের সামনে অবশ্যই চেহারা ঢেকে রেখে পর্দা করতেন। এবং এটাই ছিল তৎকালীন মহিলা সাহাবীদের আমল, এর ব্যতিক্রম কোন প্রমাণ নেই।
আবুদাউদ এর সহী হাদীস
ﻋَﻦْ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﺮُّﻛْﺒَﺎﻥُ ﻳَﻤُﺮُّﻭْﻥَ ﺑِﻨَﺎ ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﻣَﻊَ ﺭَﺳُﻮْﻝِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻣُﺤْﺮِﻣَﺎﺕٌ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺣَﺎﺫَﻭْﺍ ﺑِﻨَﺎ ﺳَﺪَﻟَﺖْ ﺇِﺣْﺪَﺍﻧَﺎ ﺟِﻠْﺒَﺎﺑَﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺭَﺃْﺳِﻬَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻬِﻬَﺎ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺟَﺎﻭَﺯُﻭْﻧَﺎ ﻛَﺸَﻔْﻨَﺎﻩُ
আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম, তখন আরোহী দল আমাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করতো। তারা আমাদের কাছাকাছি আসলে আমাদের সকলেই নিজ নিজ মাথার চাদর চেহারার উপর ঢেকে দিতাম। আর তারা চলে যেত আমরা তখন তা সরিয়ে নিতাম।
(আবূ দাঊদ:হাদীস-১৮৩৩; আহমাদ:হাদীস-২৪০২১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী:হাদীস-৯০৫১, ইবনু মাজাহ:হাদীস-২৯৩৫; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্:হাদীস-২৬৯১; মিশকাতুল মাসাবীহ: হাদীস২৬৯০
*ﻋَﻦْ ﺻَﻔِﻴَّﺔَ ﺑِﻨْﺖِ ﺷَﻴْﺒَﺔَ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﻃَﺎﻓَﺖْ ﺑِﺎﻟْﺒَﻴْﺖِ ﻭَﻫِﻲَ ﻣُﻨْﺘِﻘَﺒَﺔٌ
ছাফিয়্যাহ বিনতে শায়বাহ বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-কে নিকাব পরিহিত অবস্থায় কা‘বা ঘর তওয়াফ করতে দেখেছি।
(ইবনু সা‘দ ৮/৪৯)
কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্বের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সাথে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে।
(আরিযাতুল আহওয়াযী-৪/৫৬)
বুখারী ও মুসলিমের হাদীস:
عن عائشة…صفوان ابن المعطل السلمى….فعرفنى حين رانى، وكان رانى قبل الحجاب، فاستيقظت باسترجاع حين عرفنى فخمرت وجهى بجلبابى- بخارى:٤١٤١
হযরত আয়েশা রা. ইফ্কের দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন-আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে আমার চেহারা আবৃত করে ফেলি। সহীহ বুখারী: হাদীস-৪১৪১, সহীহ মুসলিম: হাদীস- ২৭৭০; জামে তিরমিযী: হাদীস-৩১৭৯
সহী বুখারীর অপর হাদীসে মহিলা সাহাবীদের নিকাব ও হাত মোজা ব্যবহারের প্রমাণ
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, وَلاَ تَنْتَقِبِ المَرْأَةُ المُحْرِمَةُ، وَلاَ تَلْبَسِ القُفَّازَيْنِ‘আর ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নিকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।’ (বুখারী : ১৮৩৮)
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এই হাদীস প্রমাণ করে মহিলা সাহাবীদের পর্দার সাধারণ আমল ছিল নিকাব ও হাতমোজা পরিধান করা, তাই নিয়ম অনুযায়ী ইহরামের সময় তা খুলে রাখতে বলেছেন।
ভিন্ন মত পোষণকারীদের দলীল ও তার জবাব
১নং দলিল: মহান আল্লাহ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন- وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا “তারা যেন তাদের যীনাত (সাজ-সৌন্দর্য) প্রদর্শন না করে। তবে এর যা প্রকাশিত রয়েছে তা ভিন্ন” (সূরা নূর, আয়াতঃ৩১) এ আয়াতে বর্ণিত,, إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, “তা হচ্ছে নারীর মুখমণ্ডল ও হাত।” সুতরাং বুঝা গেল- নারীদের চেহারা ও হাত খোলা রাখা যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর তাফসীর অনুযায়ী এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে- পর্দা করার কাপড় ও এর বাহ্যিক সৌন্দর্যতা, চেহারা বা হাত নয়। (বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে তাবারী-১৮/১১৮ পৃষ্ঠা; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৯/২৮০ পৃষ্ঠা)
দ্বিতীয়ত الا ما ظهر منها এর ব্যাখ্যা মুখমণ্ডল ও হাত বর্ণনা করা করাকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এর দিকে সম্মন্ধ করার রেওয়ায়াতও নির্ভরযোগ্য নয়। মুহাদ্দিসগণের নিকট তা নিতান্ত দুর্বল।
তৃতীয়ত; সূরা আহযাবের ৫৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি নারীদের চেহারা আবৃত রাখার কথা বলেছেন।{ ফতহুল বারী, শরহুল বুখারী:৮/৫৪}
এমনকি ইহরাম অবস্থায় যখন মহিলাদের চেহারায় নিকাব ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, তখনও তিনি ভিন্ন কাপড় চেহারার ওপর ফেলে মহিলাদেরকে চেহারার পর্দা করতে বলেছেন। এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, “মহিলারা তখন চেহারার ওপর জিলবাব ঝুলিয়ে দিবে, পেঁচিয়ে বাঁধবে না। ( সুল্লামুল আমানী-১৭৪ পৃষ্ঠা)
সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা কিছুতেই বেগানা পুরুষদের সামনে নারীদের চেহারা ও হাত খোলা রাখার বৈধতা প্রমানিত হয় না। বরং এ আয়াত দ্বারাও নারীদের প্রতি যীনাত বা সাজ-সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশের দ্বারা তাদের চেহারা ও হাতের সৌন্দর্য পর-পুরুষদের সামনে প্রকাশ করার নিষিদ্ধতাই প্রমানণত হয়।
২নং দলিল ইমাম আবু দাউদ রহঃ স্বীয় প্রসিদ্ধ সুনানে আবু দাউদ শরীফে হযরত আয়িশা রাঃ হতে রিওয়ায়াত করেছেন-
ان اسماء بنت ابي بكر، دخلت على رسول الله صلى الله عليه وسلم وعليها ثياب رقاق فاعرض عنها رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال “ يا اسماء ان المراة اذا بلغت المحيض لم تصلح ان يرى منها الا هذا وهذا ” . واشار الى وجهه وكفيه
একদা আসমা বিনত আবূ বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পাতলা কাপড় পরে হাযির হলে, তিনি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ হে আসমা! যখন মেয়েরা সাবালিকা হয়, তখন তাদের এমন পাতলা কাপড় পরা উচিত নয়, যাতে তাদের শরীর দেখা যায়। তবে তিনি ইশারা করে মুখমন্ডল ও দু’হাতের কব্জা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দেন।
( সুনানে আবু দাউদ-হা/৪০৫৯)
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, নারীদের চেহারা ও হাত ছাড়া সমস্ত অঙ্গ ঢাকতে হবে। সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে- নারীদের চেহারা ও হাত পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রথমতঃ
এ হাদীসকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা, এ হাদীসে রাসূল সাঃ, আসমা রাঃ কে মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কথা উল্লেখ করে নসিহত করেছেন। এতে বোঝা যায়, আসমা রাঃ তখন সদ্য প্রাপ্ত বয়স্কা হয়েছিলেন। অথচ পর্দার বিধান সম্বলিত সর্বপ্রথম আয়াত সুরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াত যখন নাজিল হয়, তখন (৫ম হিজরীতে) আসমা রাঃ এর বয়স ছিল ৩২ বছর।
দ্বিতীয়ত: অপর বিভিন্ন হাদীসের দ্বারা জানা যায়— পর্দার বিধান নাযিলের পর আসমা রাঃ পর্দার জন্য চেহারা ঢাকার ব্যাপারে এমন ইতমিনান করতেন যে, হজ্জ্বের ইহরাম অবস্থায় যখন চেহারা জড়িয়ে নিকাব পরা নিষিদ্ধ এবং চেহারা নিকাব মুক্ত রাখা ওয়াজিব, তখনও ইসলামের পর্দার হুকুম পালনে তিনি মাথার ওপর কাপড় দিয়ে ভিন্ন কাপড় ঝুলিয়ে চেহারা ঢাকতেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আসমা বিনতে আবু বকর রাঃ বলেন, “আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম।
(মুসতাদরাকে হাকিম-১/৪৫৪, হাদীস নং-১৬৬৮, যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। সনদ সহী)
এছাড়া আসমা রাঃ এর সাথে অন্য মহিলারাও চেহারা ঢেকে পর্দা করতেন। এ সম্পর্কে ফাতিমা বিনতে মুনযির রাঃ বলেন- “আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রাঃ এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম।
(মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক-১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকিম-১/৪৫৪)
তৃতীয়ত: দলিলে পেশকৃত হাদিসের রেওয়ায়াতকারিনী হযরত আয়েশা রাঃ নিজেও উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে কখনো মহিলাদের চেহারা ও হাত খোলা রাখার পক্ষে যাননি। বরং পর্দার বিধান নাযিলেরর পর তিনি পর-পুরুষ থেকে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে ফেলেন যে, কোন বেগানা পুরুষ কখনো তার চেহারা দেখেনি।
(দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী-হা/৪৩৯১ , ৪১৪১; সহীহ মুসলিম-হা/২৭৭০; জামে তিরমিযী-হা/৩১৭৯; আবূ দাঊদ-হা/১৮৩৩; আহমাদ-হা/২৪০২১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী-হা/৯০৫১, ইবনু মাজাহ-হা/২৯৩৫; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্-হা/২৬৯১; মিশকাতুল মাসাবীহ-হা/২৬৯০; হাকিম-১/৪৫৪ ইরওয়া হা/১০২৩; ছহীহ ইবনু খুযাইমা-হা/২৬৯০)
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে– চেহারা খোলার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশকৃত উক্ত হাদীসটি পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরের হুকুমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং তা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের হুকুমের সাথে সংশ্লিষ্ট। তখন সতরে আওরতের বিধান হিসেবে নারীদের মুখমণ্ডল ও হাত খোলা রেখে সমস্ত শরীর ঢাকার নিয়ম ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাঃ, আসমা রাঃ এর নিকট সেভাবেই হুকুম বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসকে সেই সময়ের উল্লেখ করে শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ বলেন, হিজাবের আয়াত নাজিলের পূর্বে মহিলাগণ জিলবাব ছাড়া বের হতেন। তখন পুরুষগণ তাদের চেহারা ও হাত অবলোকন করতেন। আর সে সময় মহিলাদের জন্য চেহারা ও হাত খোলা রাখা জায়েজ ছিল। অতঃপর যখন হিজাবের আয়াত নাযিল হয় তখন মহিলাগণ পুরুষদের থেকে লুকিয়ে যান এবং চেহারা ও হাত সহ সমস্ত শরীর জিলবাব দ্বারা ঢেকে ফেলেন।
(আল-ফুরূ-১/৬০১)
চতুর্থত: এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে জয়ীফ বা দুর্বল। তাই তা চেহারার পর্দা নির্দেশ সম্মলিত সহিহ হাদিস সমূহের বিপক্ষে দলীল যোগ্য হতে পারে না।
মুহাক্কিকগণের বর্ণনানুযায়ী এ হাদীসটিতে তিন প্রকারের দুর্বলতা বিদ্যমানঃ
(ক) হাদীসটি খালিদ ইবনে রহঃ আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ তিনি এ হাদিস আয়েশা রাঃ থেকে সরাসরি শুনেন নাই। এদিক দিয়ে হাদীসটি “মুনকাতি” (সনদ বিচ্ছিন্ন)! আর “মুনকাতি” হাদিস জয়ীফ, উল্লেখিত ক্ষেত্রে দলীলের উপযুক্ত নয়।
(খ) হাদিসের বর্ণনা সনদে সায়ীদ ইবনে বাশীর নামক একজন রাবী রয়েছে। আর তিনি জয়ীফ ও অগ্রহণযোগ্য।
(গ) হাদীসটি খালিদ ইবনে দুরাইক থেকে কাতাদাহ্ রহঃ সূত্রে “عَنْ” শব্দের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। অথচ কাতাদাহ্ হলেন মুদাল্লিস।
আর উসূল হল, কোন মুদাল্লিস সরাসরি শোনার কথা বলা ছাড়া তার থেকে “عَنْ” শব্দ দ্বারা হাদিস বর্ণিত হলে, তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সুতরাং এ হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। (বিস্তারিত দেখুনঃ কিতাবুল ইলাল ইবনে আবি হাতিম-১৪৬৩; আল কামিল ইবনে আদী-৩/১২০৯; আন নাযার ফী আহকামিন নাযার ইবনুল কাত্তান-১৬৭,১৬৮)
৩নং দলিল: সহিহ বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- “বিদায় হজের সময় তার ভ্রাতা ফজল ইবনে আব্বাস রাঃ রাসূলুল্লাহ সাঃ – এর সাওয়ারীতে পেছনে উপবিষ্ট ছিলেন। সেই সময় খুস’আম গোত্রের এক মহিলা রাসূল সাঃ – এর নিকট এসে মাসালা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তখন ফজল সেই মহিলার দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাটিও ফজলের দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃ ফজল ইবনে আব্বাসের চেহারা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন।”
এতে প্রতীয়মান হয় যে, মহিলাটির মুখমন্ডল খোলা ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাঃ তাকে চেহারা ঢাকতে নির্দেশ দেননি।
অতএব, প্রমাণিত হল, মহিলাদের জন্য চেহারা খোলা রাখা জায়িয।
মহিলাটির মুখমন্ডল খোলা ছিল — এ কথা হাদীসটির কোথাও বলা হয়নি। আর ফজল ইবনে আব্বাসের তার দিকে তাকানোতে তার চেহারা খোলা থাকা প্রমাণ হয় না। কেননা, কোন মহিলা পর্দার সাথেও কারো সাথে কিছু প্রশ্ন করলে সেই প্রশ্নোত্তরের প্রতি কৌতূহল বশতঃ অন্য কারো দৃষ্টিপাত করা অসম্ভব কিছু নয়। বরং রাসূলুল্লাহ সাঃ – এর সামনে সাহাবীয়াটি চেহারার পর্দা না করে চলে আসবেন, তা কল্পনা করা কঠিন।
অবশ্য রাসূল সাঃ এমতাবস্থায় ফজলের চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন হয়ত তাক্বওয়ার শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কেননা, এমতাবস্থায়ও কোন মহিলাদের দিকে স্বেচ্ছায় তাকিয়ে থাকা পরহেজগারী ও তাক্বওয়ার পরিপন্থী। এছাড়া হাদীসেরই অপরাপর অংশ থেকে জানা যায় সে মহিলাটি ছিল নিতান্তই একজন বেদুইন নারী। সুতরাং এ হাদীস দ্বারা মহিলাদের চেহারা খোলা রাখা জায়েজ প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই।
৪. সহিহ বুখারী ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে হযরত জাবের রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ ঈদের নামাজ শেষ করে লোকদেরকে আখিরাত সংক্রান্ত্র উপদেশ প্রদান করেন। অতঃপর তিনি মহিলাদের কাছে গিয়ে হৃদয়গ্রাহী কিছু উপদেশ পেশ করেন আর বলেনঃ হে নারী সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর পথে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দান করো। কেননা, তোমাদেরকে অধিকহারে জাহান্নামের ভাগী দেখেছি। তখন তাদের মধ্যকার কালো বর্ণের চেহারা বিশিষ্ট জৈনিক মহিলা দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন।
.
এ হাদিসের বর্ণনায় বোঝা গেল– মহিলাটির চেহারা খোলা ছিল, আবৃত ছিল না। নতুবা জাবির রাঃ কিভাবে জানতে পারলেন যে, মহিলাটির চেহারা কালো বর্ণের ছিল? সুতরাং এতে মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত না হওয়া প্রমাণিত হয়।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এ হাদীসকে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের বলে উল্লেখ করেছেন। সেক্ষেত্রে এ হাদীসে বর্ণিত মহিলাটির চেহারা খোলা বলে গণ্য করা হলেও এর দ্বারা মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত না হওয়া প্রমান হয় না। তাছাড়া এটা বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। এতগুলো শক্তিশালী দলীলের বিপরীত এটা উল্লেখযোগ্য নয়।
তাই সবরকম দলিল-প্রমাণ পর্যালোচনা করে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন– “সঠিক সিদ্ধান্ত এই যে, নারীদের জন্য পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল ও হাত-পা খোলা রাখার অবকাশ নেই।”
(মাজমূ’উল ফাতওয়া-২২/১১৪)
.
তেমনি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ বলেন, “নারীরা নামাজ আদায়ের সময় দুই হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখতে পারে, কিন্তু এভাবে বাজারে ও লোকের সমাগম স্থলে যাওয়ার অবকাশ নেই।”
(ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন-২/৪৭)
সউদির শায়খ ইবনে বায রহঃ, শায়খ ইবনে উছাইমীন ও শায়খ ইবনে জিবরীনও একই ফতোয়া দিয়েছেন। (রিসালাতুন ফিলহিজাবি ওয়াসসুফূর-১৯ পৃ; ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম-১১৬৯ পৃ.) আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে মাকাছীদুশ শরীআহ বুঝে সেই অনুযায়ী বলার ও চলার তাওফিক দান করুন!
আই.এ/নারীর চেহারা ঢেকে রাখা ফরয; চার মাযহাবের সম্মিলিত অবস্থান
মুফতী দেলোয়ার বিন গাজী: একজন গবেষকের জন্য আবশ্যক হলো দলীল ও মূলনীতির আলোকে মাসআলা স্টাডির পাশাপাশি যুগেরও স্টাডি করা এবং মাকাছীদুশ শরীআহ সামনে রাখা। এক হাজার বছর পূর্বে যা নারীদের জন্য সাধারণ আমল ছিল আজ তা ঈমান-আকীদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বোরকা-পর্দাকে অনেক মুসলিমও আজ নারীর জন্য জুলুম, অবরোধ ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে বিশ্বাস করছে, এমনকি পর্দা করার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান শাস্তিও দিচ্ছে! এই যুগের ব্যাপারে সতর্ক করেই রাসূল সা. বলেছেন: يصبح الرجل فيها مؤمنا ويمسى كافرا ‘সে যুগে কারো সকালটা থাকবে মুমিন অবস্থায়, অথচ বিকেলে দেখা যাবে সে কাফের।’
আজ বিশ্বের তাগুতি শক্তিও মুসলিম পুরুষের মুখের দাড়ি আর মুসলিম মহিলার মুখের নেকাবকে কঠিন শত্রু মনে করে। কারণ এদুটো জিনিস নারী-পুরুষের চরিত্রের রক্ষা-কবজ এবং ইসলামের সৌন্দর্যের সাইনবোর্ড।
আমরা জানি ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে বোরকা পরার বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে। গত ১১ এপ্রিল২০১৯ থেকে ফ্রান্সে এ আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী বোরকা পরা কোনো মহিলা যদি তার মুখমন্ডল দেখাতে না চান, তবে পুলিশ তাকে সর্বোচ্চ ১৫০ ইউরো বা ২১৬ ডলার জরিমানা করবে এবং তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে-যদি তিনি রাস্তা, পার্ক বা শপিংমলের মতো প্রকাশ্যস্থানে বোরকা পরে বের হন।
একজন গবেষকের সামনে এ বিষয়টিও থাকবে যে, যে যুগে নেকাব পরা নারীও ফেতনায় পতিত হচ্ছে সে যুগে নারীকে নেকাবহীন রাখা যুক্তিযুক্ত কী না!
আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের সালাত শেষ করতেন তখন মহিলাগণ চাঁদরে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করে ঘরে ফিরতেন। অন্ধকারের কারনে তখন তাঁদেরকে চেনা যেতো না।
(বুখারী-হা:৮২৫; সহীহ মুসলিম-হা:১৩৩২, ১৩৩৪; আবু দাউদ-হা:৪২৩; তিরমিজী-হা:১৫৩; ইবনে মাজাহ-হা:৬৬৯; সূনানে নাসাঈ-হা৫৪৬) এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেলো, সে যুগের মহিলারা আপাদমস্তক ঢেকে পর্দাসহ সালাত আদায় করতেন।
অন্য হাদীস
আমরা বিনতে আব্দুর রহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি আয়িশা (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, রাসূল স. যদি এ যুগের নারীদের আচরণের অবস্থা দেখতেন, তবে তাদেরকে বনী ইসরাঈলী নারীদের ন্যায় মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করতেন।
(সহীহ বুখারী-হা/৮২৭; মুসলিম-হা/৮৮৩; আবু দাউদ-হা/৫৬৯; আহমাদ-হা/২৪৬৪৬)
রাসূল স. এর যুগের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে মহিলাদের মসজিদে গমন যেখানে নিষিদ্ধের পর্যায়ে পৌছেঁছে বলে মনে করেছিলেন, সেখানে চৌদ্দশত বছর পরে শত ফেতনার মাঝে নারীদের অবস্থা এখন কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা অবশ্যই গবেষকদের ভাববার বিষয়!
চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে জমহূরে উলামা ও চার মাযহাবের বর্তমান সম্মিলিত অবস্থান:
ইমাম আবু হানিফা ও হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে অনেককে বলতে শুনা যায় যে, নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয় বরং খোলা রাখা বৈধ, এটাতো হানাফী মাযহাবেরই ফতোয়া!
আমি বলবো এভাবে বলাটা ইমাম আবু হানিফা, হানাফী মাযহাবসহ অপরাপর মাযহাব ও উক্ত মাসআলার ব্যাপারে অজ্ঞতা ও উদাসীনতার পরিচায়ক।
□ফেতনার আশঙ্কা না থাকার শর্তে কিছু দলীলের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানিফা রহ. সেই সোলানী যুগে চেহারা খোলা রাখার রুখসাত বা বৈধতার মতামত দিয়েছিলেন বটে কিন্তু পরবর্তী যুগে যখন চূড়ান্ত ফেতনা নিশ্চিত হয়ে শর্ত বিলীন হয়ে যায়, তখন ইমাম আবু হানিফার মূলনীতির আলোকেই তা অবৈধ হয়ে যায়। ফলে হানাফী মাযহাবের উলামায়ে কেরাম মূলনীতি ও দলীলের ভিত্তিতেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তা পর পুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়। এমতাবস্থায় হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে রুখসাতের পক্ষে বলা সুস্পষ্ট অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মালেকী মাযহাবের ক্ষেত্রেও একই কথা
অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের মতো মালেকী মাযহাবেও শর্তসাপেক্ষে রুখসাত ছিল, কিন্তু একই কারণে তাদেরও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নারীর চেহারা খোলা রাখা জায়েয নেই।
উল্লখ্য যে, শুরু থেকেই হানফী ও মালেকী মাযহাবের অনেক উলামায়ে কেরামক কোন শর্ত ছাড়াই চেহারা খোলা রাখাকে নাজায়েয বলে এসেছেন।
অপরপক্ষ দলীলের ভিত্তিতেই ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এবং শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের উলামায়ে কেরাম চেহারাকে ফরয পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং খোলা রাখাকে সর্বাবস্থায় নাজায়েয বলেছেন, ফেতনার আশঙ্কা থাকুক চাই না থাকুক।
চার মাযহাবের বাইরে আহলে হাদীস, সালাফীসহ অপরাপর বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামও নারীর চেহারা খোলা রাখাকে নাজায়েয বলেছেন। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম।
ফলাফল
চার মাযহাব এবং জমহূরে উলামার বর্তমান সম্মিলিত অবস্থান হলো নারীর চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত, তা পর পুরুষের সামনে খোলা রাখা বৈধ নয়। বর্তমান ফেতনার যুগে এর বাইরে বলার সুযোগও নেই।
نستطيع أن نخلص مما تقدم بأن علماء المذاهب الأربعة يكادون يتفقون على تغطية المرأة جميع بدنها عن الأجانب، سواء منهم من يرى أن الوجه والكفين عورة، ومن يرى أنهما غير عورة لكنه يوجب تغطيتهما فى هذا الزمان لفساد أكثر الناس. أدلة الحجاب: ٤٧٤
সূত্র: মিশর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট লাইব্রেরি দারু ইবনিল যাওজী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, আদিল্লাতুল হিযাব )أدلة الحجاب পৃষ্ঠা:৪৭৪, প্রথম সংস্করণ, ২০০৫ ইং ফতহুল বারী: ৯/৩৩৭, নাইলুল আওতার: ৬/১১০ রওযাতুত তালেবীন:৫/৩৩৬
হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. বলেন: চার মাযহাবের সকল ইমামের ঐকমত্যে মহিলাদের জন্য পর্দার কাপড়, বোরকা, বড় চাদর ইত্যাদি দ্বারা সমস্ত দেহ ও মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখা অপরিহার্য। (মা‘আরিফুল কুরআন, ৭/ ২২০)
এখানে চার মাযহাবের কিছু বিখ্যাত গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি, যেগুলোতে চেহারা আবৃত রাখার বিধান পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে।
হানাফী মাযহাব :
আহকামুল কুরআন, আলজাসসাস ৩/৩৭১-৩৭২; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৪০৭; আদ্দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারের সাথে), ৬/৩৭০; রদ্দুল মুহতার (ফতওয়া শামী) ১/৪০৬; আলবাহরুর রাইক ২/২৭০
মালেকী মাযহাব :
আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ৩/১৫৭৯; আলজামি লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবী ১২/১১৫; আকরাবুল মাসালিক, আহমদ দরদীর ১/২৮৯; আরিজাতুল আহওয়াযী, ইবনুল আরাবী ৪/৫৬; মাওয়াহিবুল জলীল, হাত্তাব ২/১৮১; হাশিয়াতুদ দুসূকী, মুহাম্মাদ আদ দুসূকী ১/২১৪
শাফেয়ী মাযহাব :
নেহায়াতুল মুহতাজ ইলা শারহিল মিনহাজ: ৬/১৮৭; রওযাতুত তালেবীন ৭/২১; হাওয়াশিশ শিরওয়ানী ২/৩৩৩
হাম্বলী মাযহাব :
আল আদাবুশ শরইয়্যা, ইবনু মুফলিহ ১/২৯৭; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ২/৩২৮; আলইনসাফ, মারদাভী ১/৪৫২
চেহারা আবৃত করা ফরয বিষয়ে কুরআনের দলীল
সূরা আহযাব এর আয়াত
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিন স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাব নিজেদের মাথার উপর থেকে টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
(সূরা আহযাবঃ আয়াত- ৫৯)
আল্লামা কুরতুবী রহঃ উল্লেখ করেছেন পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতের হুকুম অনুযায়ী জিলবাব দ্বারা জামাকাপড় ও ওড়না সহ সমস্ত শরীর ও চেহারা ঢাকতে হবে। (আল-জামি’ লি-আহকামিল কুরআন, কুরতুবী-১৪/২৪৩)
ইমাম সূয়ূতী রহঃ এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “এটি সকল নারীর জন্য পর্দার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত । এতে তাদের মাথা ও চেহারা ঢাকা ফরজ করা হয়েছে।
(আওনুল মা’বুদ-১১/১৫৮ পৃ.)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন,
أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن فى حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب، ويبدين عينا واحدة.
“আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে বিশেষ চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (ফাতহুল বারী,শরহুল বুখারী: ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪, তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী: ২০/৩২৪)
তাবেয়ী আবীদাহ সালমানী রহ. এর বক্তব্য
عن ابن سيرين قال: سألت عبيدة سلمانى عن قوله- يدنين عليهن من جلابيبهن- فقال بثوبه فغطى رأسه ووجهه وأبرز ثوبه عن إحدى عينيه
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযতর ইবনে সীরিন রহঃ বলেন, আমি (ইবনে মাসউদ রা. এর শাগরিদ, বিখ্যাত তাবেয়ী)আবিদাহ সালমানী রহঃ কে উক্ত আায়াতের ব্যাখা সম্পর্কে জিঙ্গাসা করলে তিনি তার “বড় চাদর দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করলেন এবং এক চোখ খোলা রাখলেন”। অর্থাৎ জিলবাব দ্বারা চেহারা আবৃত করার বাস্তব ব্যাখ্যা দেখালেন। (তাফসীরে তাবারী: ২০/৩২৪, তাফসীরে ইবনে কাছীর- ৩/৮২৫)
সূরা নূর এর আয়াত
قُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ.
হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তবে যা এমনিতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে তা ব্যতিক্রম। এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। (সূরা আন-নূর: আয়াত- ৩১)
এই আয়াতে নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর চেহারাই হলো নারীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যতা। وجه المرأة هو مجمع المحاسن، ومعيار الجمال، ومصباح البدن- أدلة الحجاب: ٤٧٤
এই আয়াত প্রসঙ্গে সহী বুখারীতে বর্ণিত হাদীস-
আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, عن عائشة أنها قالت: يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها. আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন।যখন আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত,
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ‘‘তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন ওড়না দ্বারা আবৃত করে’’
নাযিল করলেন, তখন তারা নিজ চাদর ছিঁড়ে ওড়না হিসাবে ব্যবহার করল। (সহীহ বুখারী: হাদীস-৪৩৯৮)
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, ‘ফাখতামারনা’ أى غطين وجوههن অর্থ তারা (চাদর ছিড়ে তা দ্বারা) মুখমন্ডল আবৃত করেছেন। (ফাতহুল বারী-৮/৩৪৭ পৃ.)
আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, ‘ফাখতামারনা বিহা’ অর্থাৎ যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী-১৯/৯২ পৃ.)
আল্লামা শানকীতী রাহ. বলেন, এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, উপরোক্ত মহিলা সাহাবীগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুখমন্ডল আবৃত করারও আদেশ করেছেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনার্থে নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।
(আল বায়ান-৩৪২ পৃষ্ঠা)
চেহারা আবৃত করা ফরয বিষয়ে হাদীসের দলীল
রাসূল স. ইরশাদ করেন: المرأة عورة، فإذا خرجت استشرفها الشيطان- ترمذى: ١١٧٣ “নারী হলো গোপনীয় বস্তু, যখন সে প্রকাশ্যে বের হয়, শয়তান তার দিকে উকি দিতে থাকে।” তিরমিযী: হাদীস-১১৭৩ এই হাদীসে নারীর আপাদমস্তক পুরো দেহকেই আওরাত বলা হয়েছে।
মুস্তাদরাকে হাকিম এর সহী হাদীস
ﻋَﻦْ ﺃَﺳْﻤَﺎﺀَ ﺑِﻨْﺖِ ﺃَﺑِﻲْ ﺑَﻜْﺮٍ ﺍﻟﺼِّﺪِّﻳْﻖِ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻛُﻨَّﺎ ﻧُﻐَﻄِّﻲْ ﻭُﺟُﻮْﻫَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺮِّﺟَﺎﻝِ، ﻭَﻛُﻨَّﺎ ﻧَﻤْﺘَﺸِﻂُ ﻗَﺒْﻞَ ﺫَﻟِﻚَ ﻓِﻲ ﺍﻻِﺣْﺮَﺍﻡِ-
আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) বলেন, আমরা পুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম এবং ইহরামের পূর্বে চিরুনী করতাম। (মুস্তাদরাকে হাকিম:১/৪৫৪, হাদীস নং-১৬৬৮, ইরওয়া হা/১০২৩; ছহীহ ইবনু খুযাইমা-হা/২৬৯০)
হাদিসটিতে,, “আমরা” বলা হয়েছে। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেলো যে, মহিলা সাহাবীয়য়াগন পরপুরুষের সামনে অবশ্যই চেহারা ঢেকে রেখে পর্দা করতেন। এবং এটাই ছিল তৎকালীন মহিলা সাহাবীদের আমল, এর ব্যতিক্রম কোন প্রমাণ নেই।
আবুদাউদ এর সহী হাদীস
ﻋَﻦْ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﺮُّﻛْﺒَﺎﻥُ ﻳَﻤُﺮُّﻭْﻥَ ﺑِﻨَﺎ ﻭَﻧَﺤْﻦُ ﻣَﻊَ ﺭَﺳُﻮْﻝِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻣُﺤْﺮِﻣَﺎﺕٌ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺣَﺎﺫَﻭْﺍ ﺑِﻨَﺎ ﺳَﺪَﻟَﺖْ ﺇِﺣْﺪَﺍﻧَﺎ ﺟِﻠْﺒَﺎﺑَﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺭَﺃْﺳِﻬَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﻭَﺟْﻬِﻬَﺎ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺟَﺎﻭَﺯُﻭْﻧَﺎ ﻛَﺸَﻔْﻨَﺎﻩُ
আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম, তখন আরোহী দল আমাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করতো। তারা আমাদের কাছাকাছি আসলে আমাদের সকলেই নিজ নিজ মাথার চাদর চেহারার উপর ঢেকে দিতাম। আর তারা চলে যেত আমরা তখন তা সরিয়ে নিতাম।
(আবূ দাঊদ:হাদীস-১৮৩৩; আহমাদ:হাদীস-২৪০২১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী:হাদীস-৯০৫১, ইবনু মাজাহ:হাদীস-২৯৩৫; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্:হাদীস-২৬৯১; মিশকাতুল মাসাবীহ: হাদীস২৬৯০
□ﻋَﻦْ ﺻَﻔِﻴَّﺔَ ﺑِﻨْﺖِ ﺷَﻴْﺒَﺔَ ﻗَﺎﻟَﺖْ ﺭَﺃَﻳْﺖُ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ ﻃَﺎﻓَﺖْ ﺑِﺎﻟْﺒَﻴْﺖِ ﻭَﻫِﻲَ ﻣُﻨْﺘِﻘَﺒَﺔٌ
ছাফিয়্যাহ বিনতে শায়বাহ বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-কে নিকাব পরিহিত অবস্থায় কা‘বা ঘর তওয়াফ করতে দেখেছি।
(ইবনু সা‘দ ৮/৪৯)
কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্বের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সাথে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে।
(আরিযাতুল আহওয়াযী-৪/৫৬)
বুখারী ও মুসলিমের হাদীস:
عن عائشة…صفوان ابن المعطل السلمى….فعرفنى حين رانى، وكان رانى قبل الحجاب، فاستيقظت باسترجاع حين عرفنى فخمرت وجهى بجلبابى- بخارى:٤١٤١
হযরত আয়েশা রা. ইফ্কের দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন-আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে আমার চেহারা আবৃত করে ফেলি। সহীহ বুখারী: হাদীস-৪১৪১, সহীহ মুসলিম: হাদীস- ২৭৭০; জামে তিরমিযী: হাদীস-৩১৭৯
সহী বুখারীর অপর হাদীসে মহিলা সাহাবীদের নিকাব ও হাত মোজা ব্যবহারের প্রমাণ
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, وَلاَ تَنْتَقِبِ المَرْأَةُ المُحْرِمَةُ، وَلاَ تَلْبَسِ القُفَّازَيْنِ‘আর ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নিকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।’ (বুখারী : ১৮৩৮)
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এই হাদীস প্রমাণ করে মহিলা সাহাবীদের পর্দার সাধারণ আমল ছিল নিকাব ও হাতমোজা পরিধান করা, তাই নিয়ম অনুযায়ী ইহরামের সময় তা খুলে রাখতে বলেছেন।
ভিন্ন মত পোষণকারীদের দলীল ও তার জবাব
১নং দলিল: মহান আল্লাহ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন- وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا “তারা যেন তাদের যীনাত (সাজ-সৌন্দর্য) প্রদর্শন না করে। তবে এর যা প্রকাশিত রয়েছে তা ভিন্ন” (সূরা নূর, আয়াতঃ৩১) এ আয়াতে বর্ণিত,, إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا এর ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, “তা হচ্ছে নারীর মুখমণ্ডল ও হাত।” সুতরাং বুঝা গেল- নারীদের চেহারা ও হাত খোলা রাখা যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর তাফসীর অনুযায়ী এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে- পর্দা করার কাপড় ও এর বাহ্যিক সৌন্দর্যতা, চেহারা বা হাত নয়। (বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে তাবারী-১৮/১১৮ পৃষ্ঠা; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-৯/২৮০ পৃষ্ঠা)
দ্বিতীয়ত الا ما ظهر منها এর ব্যাখ্যা মুখমণ্ডল ও হাত বর্ণনা করা করাকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এর দিকে সম্মন্ধ করার রেওয়ায়াতও নির্ভরযোগ্য নয়। মুহাদ্দিসগণের নিকট তা নিতান্ত দুর্বল।
তৃতীয়ত; সূরা আহযাবের ৫৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি নারীদের চেহারা আবৃত রাখার কথা বলেছেন।{ ফতহুল বারী, শরহুল বুখারী:৮/৫৪}
এমনকি ইহরাম অবস্থায় যখন মহিলাদের চেহারায় নিকাব ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, তখনও তিনি ভিন্ন কাপড় চেহারার ওপর ফেলে মহিলাদেরকে চেহারার পর্দা করতে বলেছেন। এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, “মহিলারা তখন চেহারার ওপর জিলবাব ঝুলিয়ে দিবে, পেঁচিয়ে বাঁধবে না। ( সুল্লামুল আমানী-১৭৪ পৃষ্ঠা)
সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা কিছুতেই বেগানা পুরুষদের সামনে নারীদের চেহারা ও হাত খোলা রাখার বৈধতা প্রমানিত হয় না। বরং এ আয়াত দ্বারাও নারীদের প্রতি যীনাত বা সাজ-সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশের দ্বারা তাদের চেহারা ও হাতের সৌন্দর্য পর-পুরুষদের সামনে প্রকাশ করার নিষিদ্ধতাই প্রমানণত হয়।
২নং দলিল ইমাম আবু দাউদ রহঃ স্বীয় প্রসিদ্ধ সুনানে আবু দাউদ শরীফে হযরত আয়িশা রাঃ হতে রিওয়ায়াত করেছেন-
ان اسماء بنت ابي بكر، دخلت على رسول الله صلى الله عليه وسلم وعليها ثياب رقاق فاعرض عنها رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال “ يا اسماء ان المراة اذا بلغت المحيض لم تصلح ان يرى منها الا هذا وهذا ” . واشار الى وجهه وكفيه
একদা আসমা বিনত আবূ বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পাতলা কাপড় পরে হাযির হলে, তিনি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ হে আসমা! যখন মেয়েরা সাবালিকা হয়, তখন তাদের এমন পাতলা কাপড় পরা উচিত নয়, যাতে তাদের শরীর দেখা যায়। তবে তিনি ইশারা করে মুখমন্ডল ও দু’হাতের কব্জা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দেন।
( সুনানে আবু দাউদ-হা/৪০৫৯)
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, নারীদের চেহারা ও হাত ছাড়া সমস্ত অঙ্গ ঢাকতে হবে। সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে- নারীদের চেহারা ও হাত পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রথমতঃ
এ হাদীসকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা, এ হাদীসে রাসূল সাঃ, আসমা রাঃ কে মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কথা উল্লেখ করে নসিহত করেছেন। এতে বোঝা যায়, আসমা রাঃ তখন সদ্য প্রাপ্ত বয়স্কা হয়েছিলেন। অথচ পর্দার বিধান সম্বলিত সর্বপ্রথম আয়াত সুরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াত যখন নাজিল হয়, তখন (৫ম হিজরীতে) আসমা রাঃ এর বয়স ছিল ৩২ বছর।
দ্বিতীয়ত: অপর বিভিন্ন হাদীসের দ্বারা জানা যায়— পর্দার বিধান নাযিলের পর আসমা রাঃ পর্দার জন্য চেহারা ঢাকার ব্যাপারে এমন ইতমিনান করতেন যে, হজ্জ্বের ইহরাম অবস্থায় যখন চেহারা জড়িয়ে নিকাব পরা নিষিদ্ধ এবং চেহারা নিকাব মুক্ত রাখা ওয়াজিব, তখনও ইসলামের পর্দার হুকুম পালনে তিনি মাথার ওপর কাপড় দিয়ে ভিন্ন কাপড় ঝুলিয়ে চেহারা ঢাকতেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আসমা বিনতে আবু বকর রাঃ বলেন, “আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম।
(মুসতাদরাকে হাকিম-১/৪৫৪, হাদীস নং-১৬৬৮, যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। সনদ সহী)
এছাড়া আসমা রাঃ এর সাথে অন্য মহিলারাও চেহারা ঢেকে পর্দা করতেন। এ সম্পর্কে ফাতিমা বিনতে মুনযির রাঃ বলেন- “আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রাঃ এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম।
(মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক-১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকিম-১/৪৫৪)
তৃতীয়ত: দলিলে পেশকৃত হাদিসের রেওয়ায়াতকারিনী হযরত আয়েশা রাঃ নিজেও উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে কখনো মহিলাদের চেহারা ও হাত খোলা রাখার পক্ষে যাননি। বরং পর্দার বিধান নাযিলেরর পর তিনি পর-পুরুষ থেকে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে ফেলেন যে, কোন বেগানা পুরুষ কখনো তার চেহারা দেখেনি।
(দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী-হা/৪৩৯১ , ৪১৪১; সহীহ মুসলিম-হা/২৭৭০; জামে তিরমিযী-হা/৩১৭৯; আবূ দাঊদ-হা/১৮৩৩; আহমাদ-হা/২৪০২১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী-হা/৯০৫১, ইবনু মাজাহ-হা/২৯৩৫; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্-হা/২৬৯১; মিশকাতুল মাসাবীহ-হা/২৬৯০; হাকিম-১/৪৫৪ ইরওয়া হা/১০২৩; ছহীহ ইবনু খুযাইমা-হা/২৬৯০)
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে– চেহারা খোলার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশকৃত উক্ত হাদীসটি পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরের হুকুমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং তা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের হুকুমের সাথে সংশ্লিষ্ট। তখন সতরে আওরতের বিধান হিসেবে নারীদের মুখমণ্ডল ও হাত খোলা রেখে সমস্ত শরীর ঢাকার নিয়ম ছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাঃ, আসমা রাঃ এর নিকট সেভাবেই হুকুম বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসকে সেই সময়ের উল্লেখ করে শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ বলেন, হিজাবের আয়াত নাজিলের পূর্বে মহিলাগণ জিলবাব ছাড়া বের হতেন। তখন পুরুষগণ তাদের চেহারা ও হাত অবলোকন করতেন। আর সে সময় মহিলাদের জন্য চেহারা ও হাত খোলা রাখা জায়েজ ছিল। অতঃপর যখন হিজাবের আয়াত নাযিল হয় তখন মহিলাগণ পুরুষদের থেকে লুকিয়ে যান এবং চেহারা ও হাত সহ সমস্ত শরীর জিলবাব দ্বারা ঢেকে ফেলেন।
(আল-ফুরূ-১/৬০১)
চতুর্থত: এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে জয়ীফ বা দুর্বল। তাই তা চেহারার পর্দা নির্দেশ সম্মলিত সহিহ হাদিস সমূহের বিপক্ষে দলীল যোগ্য হতে পারে না।
মুহাক্কিকগণের বর্ণনানুযায়ী এ হাদীসটিতে তিন প্রকারের দুর্বলতা বিদ্যমানঃ
(ক) হাদীসটি খালিদ ইবনে রহঃ আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ তিনি এ হাদিস আয়েশা রাঃ থেকে সরাসরি শুনেন নাই। এদিক দিয়ে হাদীসটি “মুনকাতি” (সনদ বিচ্ছিন্ন)! আর “মুনকাতি” হাদিস জয়ীফ, উল্লেখিত ক্ষেত্রে দলীলের উপযুক্ত নয়।
(খ) হাদিসের বর্ণনা সনদে সায়ীদ ইবনে বাশীর নামক একজন রাবী রয়েছে। আর তিনি জয়ীফ ও অগ্রহণযোগ্য।
(গ) হাদীসটি খালিদ ইবনে দুরাইক থেকে কাতাদাহ্ রহঃ সূত্রে “عَنْ” শব্দের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। অথচ কাতাদাহ্ হলেন মুদাল্লিস।
আর উসূল হল, কোন মুদাল্লিস সরাসরি শোনার কথা বলা ছাড়া তার থেকে “عَنْ” শব্দ দ্বারা হাদিস বর্ণিত হলে, তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সুতরাং এ হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। (বিস্তারিত দেখুনঃ কিতাবুল ইলাল ইবনে আবি হাতিম-১৪৬৩; আল কামিল ইবনে আদী-৩/১২০৯; আন নাযার ফী আহকামিন নাযার ইবনুল কাত্তান-১৬৭,১৬৮)
৩নং দলিল: সহিহ বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- “বিদায় হজের সময় তার ভ্রাতা ফজল ইবনে আব্বাস রাঃ রাসূলুল্লাহ সাঃ – এর সাওয়ারীতে পেছনে উপবিষ্ট ছিলেন। সেই সময় খুস’আম গোত্রের এক মহিলা রাসূল সাঃ – এর নিকট এসে মাসালা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তখন ফজল সেই মহিলার দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাটিও ফজলের দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃ ফজল ইবনে আব্বাসের চেহারা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন।”
এতে প্রতীয়মান হয় যে, মহিলাটির মুখমন্ডল খোলা ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাঃ তাকে চেহারা ঢাকতে নির্দেশ দেননি।
অতএব, প্রমাণিত হল, মহিলাদের জন্য চেহারা খোলা রাখা জায়িয।
মহিলাটির মুখমন্ডল খোলা ছিল — এ কথা হাদীসটির কোথাও বলা হয়নি। আর ফজল ইবনে আব্বাসের তার দিকে তাকানোতে তার চেহারা খোলা থাকা প্রমাণ হয় না। কেননা, কোন মহিলা পর্দার সাথেও কারো সাথে কিছু প্রশ্ন করলে সেই প্রশ্নোত্তরের প্রতি কৌতূহল বশতঃ অন্য কারো দৃষ্টিপাত করা অসম্ভব কিছু নয়। বরং রাসূলুল্লাহ সাঃ – এর সামনে সাহাবীয়াটি চেহারার পর্দা না করে চলে আসবেন, তা কল্পনা করা কঠিন।
অবশ্য রাসূল সাঃ এমতাবস্থায় ফজলের চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন হয়ত তাক্বওয়ার শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কেননা, এমতাবস্থায়ও কোন মহিলাদের দিকে স্বেচ্ছায় তাকিয়ে থাকা পরহেজগারী ও তাক্বওয়ার পরিপন্থী। এছাড়া হাদীসেরই অপরাপর অংশ থেকে জানা যায় সে মহিলাটি ছিল নিতান্তই একজন বেদুইন নারী। সুতরাং এ হাদীস দ্বারা মহিলাদের চেহারা খোলা রাখা জায়েজ প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই।
৪. সহিহ বুখারী ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে হযরত জাবের রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ ঈদের নামাজ শেষ করে লোকদেরকে আখিরাত সংক্রান্ত্র উপদেশ প্রদান করেন। অতঃপর তিনি মহিলাদের কাছে গিয়ে হৃদয়গ্রাহী কিছু উপদেশ পেশ করেন আর বলেনঃ হে নারী সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর পথে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দান করো। কেননা, তোমাদেরকে অধিকহারে জাহান্নামের ভাগী দেখেছি। তখন তাদের মধ্যকার কালো বর্ণের চেহারা বিশিষ্ট জৈনিক মহিলা দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন।
.
এ হাদিসের বর্ণনায় বোঝা গেল– মহিলাটির চেহারা খোলা ছিল, আবৃত ছিল না। নতুবা জাবির রাঃ কিভাবে জানতে পারলেন যে, মহিলাটির চেহারা কালো বর্ণের ছিল? সুতরাং এতে মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত না হওয়া প্রমাণিত হয়।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম এ হাদীসকে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বের বলে উল্লেখ করেছেন। সেক্ষেত্রে এ হাদীসে বর্ণিত মহিলাটির চেহারা খোলা বলে গণ্য করা হলেও এর দ্বারা মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভুক্ত না হওয়া প্রমান হয় না। তাছাড়া এটা বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। এতগুলো শক্তিশালী দলীলের বিপরীত এটা উল্লেখযোগ্য নয়।
তাই সবরকম দলিল-প্রমাণ পর্যালোচনা করে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন– “সঠিক সিদ্ধান্ত এই যে, নারীদের জন্য পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল ও হাত-পা খোলা রাখার অবকাশ নেই।”
(মাজমূ’উল ফাতওয়া-২২/১১৪)
তেমনি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ বলেন, “নারীরা নামাজ আদায়ের সময় দুই হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখতে পারে, কিন্তু এভাবে বাজারে ও লোকের সমাগম স্থলে যাওয়ার অবকাশ নেই।”
(ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন-২/৪৭)
সউদির শায়খ ইবনে বায রহঃ, শায়খ ইবনে উছাইমীন ও শায়খ ইবনে জিবরীনও একই ফতোয়া দিয়েছেন। (রিসালাতুন ফিলহিজাবি ওয়াসসুফূর-১৯ পৃ; ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম-১১৬৯ পৃ.) আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে মাকাছীদুশ শরীআহ বুঝে সেই অনুযায়ী বলার ও চলার তাওফিক দান করুন!
Leave a Reply