।।বেনাপোলে দু’বাংলার ভাষা প্রেমীদের মিলন মেলা।।
☞লেখকঃ মোঃ আব্দুল মুননাফ
সম্পাদক ও প্রকাশক
গ্রামের সংবাদ বেনাপোল☜
আবার এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি; রাষ্ট্র সীমার বিভেদ ভুলে শূন্যরেখায় আবার মিলেছে দুই বাংলার মানুষ। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের দিনটিতে দুই বাংলার মোহনা বেনাপোলের এই মিলনমেলায় এক সময়ের এক থাকার সুরই যেন বেজে উঠল দুই পারের বাংলাভাষীদের মনে।
শুক্রবার সকাল থেকেই গান, আবৃত্তি আর দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী -রাজনীতিবিদ ও সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে বেনাপোল আর পেট্রাপোল।
অমর একুশের অমর সুরের সঙ্গে মঞ্চ থেকে ভেসে আসা “একই আকাশ, একই বাতাস/এক হৃদয়ে একই তো শ্বাস” গানের সুর যেন বেঁধে রাখে সবাইকে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ সৃষ্টি হলে ভাগ হয়ে যায় বাংলা। পাকিস্তানের অংশে থাকা পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়। পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ভারতের রাজ্য হয়ে।
২০০২ সালে ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দুই বাংলার ‘ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা-পদ্মা ভাষা ও মৈত্রী সমিতির’ উদ্যোগে সীমান্তবর্তী প্রায় ২০টি সংগঠন বেনাপোল-পেট্রাপোলের এই মিলন মেলার সূচনা করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক শার্শা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উনিশ বছরে এসে বেড়েছে এ মিলনমেলার পরিধি; তৈরি হয়েছে আস্থা ও ভালোবাসার বন্ধন।
“এবার দুই বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন কমিটি পৃথক পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।এপারে আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবনের সামনে আর ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের রপ্তানি টার্মিনালে তৈরি করা হয়েছে দুটি ‘একুশে মঞ্চ’। বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীরা সেই মঞ্চে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।”
সরেজমিনের দেখা গেছে,কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও কয়েক ঘণ্টার জন্য যেন উধাও হয়ে যায় সীমান্তের কাঁটাতার; দুই বাংলার মানুষ সীমান্তে মিলিত হয় আলিঙ্গনে; মেতে উঠে আড্ডায়-স্মৃতিচারণে।তবে এবার তালিকা ভুক্ত ভিআইপি ভিভিআইপি,রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সাংবাদিক ছাড়া অন্য কাউকে শুন্যরেখায় যেতে দেওয়া হয়নি।
আগে থেকেই নিজ নিজ ভূখন্ডে অপেক্ষায় ছিলেন আয়োজকরা। ঘড়িতে যখন সকাল ১০টা ৩৫মিনিট, তখন সীমানা পেরিয়ে শুন্যরেখায় পা রাখেন পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বনগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্য, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের মেন্টর গোপাল শেঠ, দমদম পৌরসভার সিআইপি রিঙ্কু দে দত্তসহ ভারতীয় কবি-শিল্পী-সাংবাদিক সাহিত্যিকদের একটি প্রতিনিধিদল।
আর এপার থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন, অতিরিক্ত কাস্টমস কমিশনার ড. নেয়ামুল হক, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল জলিল, শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু, শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডলসহ কবি-শিল্পী-সাংবাদিক সাহিত্যিকরা ফুল দিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান।
পরে দুই বাংলার মানুষ নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে শূন্যরেখায় নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য গ্রামের সংবাদকে বলেন, ৫২র ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। এ জন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
“বাঙালির অর্জনকে দুই বাংলা একসঙ্গে পালন করছি, এটা খুবই গর্বের বিষয়। দুই দেশের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মৈত্রীতে এটা অনুপ্রেরণা যোগাবে।”
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, আপনারা বাঙ্গালীরা ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কোথাও নেই। এ জন্য আপনারা গর্বিত জাতি।
“একুশের গৌরবের উত্তরাধিকারী পৃথিবীর সব বাঙালি। এর ব্যাপ্তি শুধু ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক বিস্তৃত। ভাষার টানে বাঙালি জাতির নাড়ির টানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে এখানে এসেছি।”
যশোর-১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন গ্রামের সংবাদকে বলেন, “ভাষার জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছেন এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই। এ কারণে বাঙালি আজ বিশ্বের দরবারে গর্বিত।”
ভাষা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ দুই দেশের বাংলা ভাষাভাষিদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিতকে আরো শক্তিশালী করবে।তাই দুই বাংলার মধ্যে শুধু একুশের অনুষ্ঠান নয়,অন্যান্য জাতীয় দিবসেও এ রকম অনুষ্ঠান করার কথা আমরা ভাবছি বলে জানান আফিল উদ্দিন।
বনগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্য বলেন, “২০০২ সাল থেকে বনগাঁর কিছু সংস্কৃতিকর্মী ‘একুশে উদযাপন কমিটি’ গড়ে সীমান্তের শূন্যরেখায় মাতৃভাষা দিবস পালন শুরু করেন। সেই থেকে প্রতিবছর একদিনের জন্য খুলে যায় সীমান্তের গেইট, বসছে দুই বাংলার মিলনমেলা। তবে এবার নিরাপত্তা ও করোনা ভাইরাসের কারনে শুন্যরেখায় প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পী ক্লোজআপ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন সানিয়া সুলতানা লিজা, মোল্লা বাবু, কবি ফকরে আলম, ভৌরব নাট্য গোস্টি সংগীত পরিবেশন করেন।
Leave a Reply